
জামাল উদ্দিন : ঘটনার দিন ব্লগার নিলয় হত্যার মিশন ছিল সাড়ে চার ঘণ্টার। তবে বাসায় ঢুকে অপারেশন শেষ করতে খুনিরা সময় নেয় মাত্র ১০ মিনিট। এছাড়া নিলয় হত্যার আগে দুই সপ্তাহ নজরদারিতে রাখা হয় তাকে। হত্যাকাণ্ড নির্বিঘ্ন করতে রাতে এলাকায় পাহারা দেওয়া দুটি কুকুরকেও হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে দেওয়া আনসার আল ইসলামের বক্তব্য, মামলার এজাহার, নিহতের স্ত্রী আশা মনির বরাত দিয়ে পুলিশের তৈরি সুরতহাল প্রতিবেদন ও গোয়েন্দাদের কাছ থেকে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে।
স্থানীয় সূত্রের বরাত দিয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, বিগত দুই সপ্তাহ খুনিরা নিলয়ের গতিবিধি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণে রাখে। তার বাসার আশে-পাশেই সার্বক্ষণিক অবস্থান করে দুই খুনি। গোড়ানের ওই সড়কে দুটি কুকুর রাতে পাহারা দিত। খুনিরা রাতে পর্যবেক্ষণ করতে গেলে কুকুর দুটি তাদের ধাওয়া দিত। সেজন্য এক সপ্তাহ আগেই পরপর দুরাতে তারা ওই কুকুর দুটিকে হত্যা করে নিজেদের যাতায়াত নির্বিঘ্ন করে। শুক্রবার ওই দুজনের গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে আরও তিন খুনি ঘটনাস্থলে যায়। চারজন বাসায় ঢুকলেও একজন রাস্তায় সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখে বলে জানান ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা।
রাজধানীর পূর্ব গোড়ানের ৮ নম্বর রোডের ১৬৭ নম্বর বাড়ির পঞ্চম তলার ভাড়া বাসায় শুক্রবার দুপুরে দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হন নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায় ওরপে নিলয়। এ সময় তার স্ত্রী আশা মনি ও শ্যালিকা ইশরাত তন্বী ঘরে ছিলেন। দুর্বৃত্তরা তাদের দুজনকে বারান্দায় ও রান্নাঘরে আটকে রেখেছিল। ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পর এ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে আনসার আল ইসলাম নামের একটি জঙ্গি সংগঠন দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে পরপর দুটি ইমেইল বার্তা পাঠায়।
আল কায়েদা ইন্ডিয়া সাব কন্টিনেন্টের (আকিস) বাংলাদেশ শাখা আনসার আল ইসলামের মুখপাত্র পরিচয় দিয়ে মুফতি আবদুল্লাহ আশরাফ দুটি ইমেইল পাঠান গণমাধ্যমে। প্রথম ইমেইল বার্তাটিতে হত্যাকাণ্ডের মিশন শেষ হওয়ার সময় উল্লেখ করে দায় স্বীকার করলেও দ্বিতীয় ইমেইল বার্তাটিতে মিশন শুরুর সময়টি উল্লেখ করা হয় সকাল ৯টায়। আর মিশন শেষ করে নিরাপদে সরে যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয় দুপুর ১টা ৪৫ মিনিট। নিলয় হত্যাকাণ্ডটি পূর্ব পরিকল্পিত হলেও পারিপার্শিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের জন্য জুমার নামাজের সময়টি বেছে নেয়া হয়। কারণ এ সময়ে মানুষ মসজিদেই থাকে বেশি।
নিলয়ের স্ত্রী আশা মনির বরাত দিয়ে সুরতহাল প্রতিবেদনে খিলগাঁও থানার এসআই হিরু মোল্লা উল্লেখ করেন, দুপুর ১টা ১০ থেকে ১টা ২০ মিনিটের মধ্যেই ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে নিলয়কে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ২টা বাজার পাঁচ মিনিট আগে খবর পেয়ে থানা থেকে তিনি ঘটনাস্থলে গিয়ে নিলয়ের মৃতদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন।
সুরতহাল প্রতিবেদনে এসআই হিরু মোল্লা বলেন, ডান গালের নিচ থেকে থুতনি বরাবর চার ইঞ্চি ও ঘাড়ের উপরি অংশে চার ইঞ্চি গভীর কাটা দাগ ছিল। মাথার ডানপাশে তিন ইঞ্চি গভীর কাটা দাগ ছিল। এছাড়া বাম হাতের তিনটি ও বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলিটি ধারালো অস্ত্রের আঘাতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ডান হাতের বাহুতে চার ইঞ্চি ও কব্জিতে কাটা দাগ ছিল।
নিলয়ের দেহে ধারালো অস্ত্রের ১২ আঘাতের চিহ্ন পেয়েছেন ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা। এসব আঘাতের মধ্যে আটটি আঘাত গুরুতর। অভিজিৎ রায়সহ অন্য ব্লগারদের যেভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল, একইভাবে নিলয়কেও কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক হাবিবুজ্জামান চৌধুরী সাংবাদিকদের জানান, নিলয়ের শরীরে ১২টি আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। গলায় ও থুতনির আটটি আঘাত গভীর। এছাড়া শরীরের বিভিন্নস্থানে আরও চারটি কাটা জখম ছিল। হত্যা নিশ্চিত করতেই এতগুলো আঘাত করা হয়েছে বলে তার ধারণা।
আহমেদ রাজীব হায়দার, অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু এবং সিলেটে অনন্ত বিজয় দাশ হত্যার ক্ষেত্রেও দুর্বৃত্তরা একই কায়দায় মাথা, গলা ও ঘাড়ে আঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ময়নাতদন্তের পর নিলয়ের চাচা বিমল চট্টোপাধ্যায় নিহত নিলয়ের লাশ গ্রহণ করেন। হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে শুক্রবার রাতেই তিনি পিরোজপুর থেকে ঢাকায় আসেন। পিরোজপুর সদর থানায় চলিশায় নিলয়ের শেষকৃত্য হবে বলে সাংবাদিকদের জানান তিনি। নিলয়ের বাবা তারাপদ চট্টোপাধ্যায় ও মা অর্পণা চট্টোপাধ্যায় পিরোজপুরের গ্রামের বাড়িতেই থাকেন।
সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় গোড়ামির বিরুদ্ধে লেখালেখি করতেন নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায় ওরফে নিলয়। তিনি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কালেকটিভ নামে একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করতেন। শুক্রবার রাতেই তার স্ত্রী আশা মনি অজ্ঞাত চারজনকে আসামি করে খিলগাঁও থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলাটি পুলিশ নথিভুক্ত করে রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অর্গানাইজড ক্রাইম শাখার অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার রায়হান উদ্দিন জানান, যে মোবাইল ফোন নম্বর থেকে আনসার আল ইসলামের নেতা পরিচয়ে ফোন দিয়েছিল সেই ফোন নম্বরটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এটি তদন্তের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলেও জানান তিনি।-বাংলা ট্রিবিউন
পাঠকের মতামত